বিজ্ঞানের ৫টি আবিষ্কার যা বদলে দিয়েছে বিশ্বকে
বিজ্ঞানের ৫টি আবিষ্কার যা বদলে দিয়েছে বিশ্বকে
আদিম যুগ থেকে মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা জীবনযাপন কে কিছুটা সহজ করতে বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করত, আবিষ্কার করত বিভিন্ন ধরনের জিনিস। তারা বিভিন্ন অস্ত্র ও সরল যন্ত্র তৈরি করত জীবনের ঝুঁকি কমাতে ও পরিশ্রম লাঘব করতে।
নতুন নতুন উপায় ও পদ্ধতি দিয়ে বদলে ফেলত নিজেদের জীবনযাপনের ধারা। আগুন দিয়ে কিভাবে খাবার পুড়িয়ে খেতে হয় অথবা কিভাবে ঘর বানিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে হয় সবই মানব সভ্যতা আয়ত্ত করেছে ধীরে ধীরে। মানুষের এই নতুনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আর আবিষ্কারের নেশা মানুষকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনের দিকে।
বিজ্ঞান বলতে আমরা বুঝি কোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান, আর এই বিশেষ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মানুষ যা কিছু আবিষ্কার করেছে তা ই হল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তাই বলা যায় যে বিজ্ঞানের চর্চা মানুষ সে আদিম যুগ থেকেই করে আসছে। আদিম যুগ থেকেই মানুষ তাদের বিশেষ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে একের পর এক উদ্ভাবন করেছে নানান যন্ত্র ও পদ্ধতি।
তবে মানব ইতিহাসে এমন কিছু আবিষ্কার আছে যা কি না পরিবর্তন করে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। আজ আমরা বিজ্ঞানের এমনই ৫টি আবিষ্কার সম্পর্কে জানব, জানব কি ছিল এর পেছনের ইতিহাস। [এখানে কোন ক্রম অনুযায়ী সাজানো হয় নি]
১। বৈদ্যুতিক বাতি
বৈদ্যুতিক বাতির উপকারিতা সম্পর্কে নতুন করে তেমন কিই বা বলার আছে। এর উপকারিতা বলে শেষ করার মত নয়। রাতের আধার দূর করে বৈদ্যুতিক বাতি শুধু আমাদের চারদিক আলোকিতই করে নি, এটি বরঞ্চ আলোকিত করেছে মানব সভ্যতার ভবিষ্যতকে।
আমরা জানি টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেন। তবে শুধু তার হাত ধরেই এটি সম্ভব হয়েছে বললে ভুল হবে। বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারের পেছনে অনেক বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে।
বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটে ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টার হাত ধরে ১৮০০ সালের দিকে। এরপর হাম্ফ্রি ডেভি নামের একজন বিজ্ঞানী ভোল্টাইক পাইলকে চারকোল ইলেক্ট্রোডের সাথে যুক্ত করে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। এভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের প্রক্রিয়া।
তবে এই যাত্রার শেষ হয় জোসেফ সোয়ান ও টমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে। জোসেফ সোয়ান ১৮৫০ সালের দিকে ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতর ফিলামেন্ট রেখে বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। ফিলামেন্ট হিসেবে তিনি ব্যাবহার করেন কার্বন যুক্ত কাগজ। তবে সে সময়ে এই ভ্যাকুয়াম টিউবের পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। ফলে তার এ পদ্ধতি শুধু আবিষ্কার হিসেবেই অসাধারণ ছিল দৈনন্দিন জীবনে ব্যাবহারের জন্য নয়।
টমাস আলভা এডিসন এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। তার ধারনাটি ছিল এমন যে যদি ফিলামেন্টটিকে পাতলা এবং কোন অধিক রোধের বস্তু দিয়ে তৈরি করা যায় তাহলে এটি খুব অল্প বিদ্যুতেই জ্বলে উঠবে। এই ধারনার উপর ভিত্তি করে তিনি ১৮৭৯ সালে তার আবিষ্কারটি প্রকাশ করেন। এর পর এডিসন ও তার দল বিভিন্নভাবে এই বাতিকে সহজলভ্য ও টেকসই করার জন্য বিভিন্ন ভাবে গবেষণা করে গেছেন।
যদিও বৈদ্যুতিক বাতির পেছনে অনেকের অবদান থাকায় এর পেটেন্ট নিয়ে বেশ জল ঘোলাই হয়েছিল। এডিসনের সাথে অনেক বিজ্ঞানীরই এ নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। তবে সব কিছু ছাপিয়ে এডিসনের এই আবিষ্কার মানব জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছিল।
২। চাকা
সম্ভবত মানুষের জীবন ধারাকে আমূল বদলে দেওয়া প্রথম আবিষ্কারটি ছিল চাকা। অনেকের মনে হতে পারে এটি আবার এমন কি আবিষ্কার। কিন্তু ৩৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই সামান্য আবিষ্কারটিই ছিল বিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন
একবার ভেবে দেখুন তো, বর্তমান সময়ে আমরা কতটা চাকার উপর নির্ভরশীল। দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমন কিংবা ভারী মালপত্র বহনে আমরা যে যানবাহনের ব্যাবহার করি তার সূত্রপাত এই চাকার হাত ধরেই। সভ্যতার অগ্রগতিতে আমরা জলে, স্থলে বা আকাশে গমন করতে পারে এমন অনেক বাহন পেয়েছি কিন্তু সবকিছুর সূত্রপাত হয়েছে ৩৬০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের দিকে চাকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই।
সভ্যতার শুরুতে মানুষকে পায়ে হেটে পথ পাড়ি দিতে হত। মালপত্র পরিবহন থেকে শুরু করে যে কোন পরিবহনের জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হত কায়িক শ্রমের উপর। মাঝে মাঝে মানুষ বিভিন্ন পশুকে তাদের এই পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করত। কিন্তু সেটিও ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত।
৩। কম্পিউটার
বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হল কম্পিউটার। বলতে গেলে বর্তমান বিশ্ব চলছে এই কম্পিউটারের উপর ভর করেই। আসলে মানব সভ্যতায় কম্পিউটারের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না।
যে কাজ গুলো আগে মানুষের করতে মাথার ঘাম ছুটে যেত সেসব কাজ আজ মুহূর্তেই আমরা করে ফেলছি কম্পিউটারের বদলোতে। আবার এমন কিছু কাজ কম্পিউটারের সহায়তায় আমরা করতে পারছি, কম্পিউটার ছাড়া সেসব কাজ কল্পনা করাও কঠিন।
মূলত চার্লস ব্যাবেজ কে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। তবে কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরে পুরানো। এই আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় অ্যাবাকাস নামে এক ধরনের গণনা যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় ব্যবহৃত হত এই অ্যাবাকাস নামক গণনা যন্ত্রটি।
এরপর উল্লেখযোগ্য গণনা যন্ত্র ছিল জন নেপিয়ারের আবিষ্কৃত নেপিয়ারের বোন যন্ত্রটি। এই যন্ত্রে ব্যবহৃত হত নয়টি ভিন্ন ভিন্ন বোন বা হার যা দিয়ে গুন বা ভাগ করা যেত। এই যন্ত্রেই সর্বপ্রথম দশমিক সংখ্যা-পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
এরপর অবশ্য সপ্তদশ শতক পর্যন্ত গণনা যন্ত্রের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয় নি। তবে এই খরা কাটে ব্রেইজ প্যাসকেল এর হাত ধরে। ব্রেইজ প্যাসকেল সর্বপ্রথম পৃথিবীর প্রথম সার্থক ক্যালকুলেটিং মেশিন আবিষ্কার করেন, বর্তমানে যা আমরা ক্যালকুলেটর নামে চিনি। তার এই ক্যালকুলেটর দিয়ে যোগ- বিয়োগ করা গেলেও গুন ও ভাগ করা যেত না। পরবর্তীতে প্যাসকেল বিভিন্ন সময় এই যন্ত্রের উন্নতি সাধন করেছিলেন।
১৯৪৪ সালে বিশ্বে সর্ব প্রথম স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারটি তৈরি করেন অধ্যাপক হাওয়ার্ড আইকেন এবং আইবিএম এর প্রকৌশলীরা।
কম্পিউটারটি তৈরি করা হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটি পরিচিত ছিল মার্ক-1 নামে। এটি অনেক বড় বড় গাণিতিক হিসাবে পারদর্শী ছিল। এভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে কম্পিউটারের উন্নতি সাধন। আর এই যন্ত্রটি কি করতে পারে তা আজ আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি।
৪। টেলিফোন
টেলিফোন আবিষ্কার ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি কল্পনাতীত অধ্যায়। একবার ভাবুন তো, আমরা আধুনিক যুগে এসেও যখন মোবাইল ফোনে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য-প্রান্তে, দূর থেকে দূরান্তে কারও সাথে কথা বলি, একটু হলেও কি অবাক হই না।
তাহলে বুঝুন এই যন্ত্র আবিষ্কারের পর মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল। বিজ্ঞানের এমন অনেক আবিষ্কার আছে যা আবিষ্কারের পূর্বে কাউকে বললে সে নির্ঘাত আপনাকে পাগল বলবে। টেলিফোন আবিষ্কার ছিল তেমনই একটা ব্যাপার।
আলেক্সেন্ডার গ্রাহামবেল কে টেলিফোনের আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হলেও এ নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এবং ইলিশা গ্রে উভয়ই ওয়াশিংটনের পেটেন্ট অফিসে ১৮৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেলিফোন আবিষ্কারের পেটেন্ট এপ্লিকেশন জমা দেন।
তবে গ্রাহামবেলের আবেদন টি আগে নিবন্ধিত হয়। ১৮৭৬ সালের মার্চে এই পেটেন্টটি নিবন্ধিত হয়। ১৮৭৬ সালের জুনে ফিলাডেলফিয়ার বিশ্ব প্রদর্শনীতে বেল প্রথমবারের মতো এক বিশাল দর্শক উপস্থিতির সামনে তার আবিষ্কৃত টেলিফোন উপস্থাপন করেছিলেন। এই যন্ত্রটি সফলতার সাথে একপ্রান্তে উচ্চারিত শব্দ অপর প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারত।
অবশ্য গ্রামবেলের টেলিফোনটি ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে খানিকটা কষ্টসাধ্য ছিল। তবে ১৮৭৭ সালে বেল টেলিফোন কোম্পানি টেলিফোনকে সহজে ব্যবহারযোগ্য করে উৎপাদন শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে ইউরোপের বাজারে ছড়িয়ে দিতে থাকে।
৫। ইন্টারনেট
বর্তমান যুগ তথ্য ও প্রযুক্তির যুগ। আর এটি শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এমনকি কম্পিউটার জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছে ইন্টারনেট। আমরা এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছি যে ইন্টারনেট ছাড়া আমরা একটি দিন ও কল্পনা করতে পারি না। হাজার হাজার সুযোগ সুবিধা দেওয়া এই ইন্টারনেট সত্যিই বিজ্ঞানের এক বিরাট চমক।
ইন্টারনেট বিশ্বব্যাপী তথ্য আদান প্রদান ও প্রচারের জন্য একটি অভূতপূর্ব মাধ্যম। এটি এমন একটি মাধ্যম যা কিনা অতিক্রম করে ফেলেছে যে কোন ভৌগলিক সীমানা।
মূলত ১৯৬০ এর গোঁড়ার দিকে ইন্টারনেটের আগমন ঘটে। এম-আইটির জে.সি.আর. লিক্লাইডার “ইন্টারগ্যাল্যাক্টিক নেটওয়ার্ক” নামক একটি ধারণার জন্ম দেন। এই পদ্ধতিতে সকল কম্পিউটার কে একটি নেটওয়ার্ক এর আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন।
এরপর ১৯৬০ এর শেষের দিকে ARPANET বা Advanced Research Projects Agency Network এর আগমন ঘটে। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের অর্থায়নে তৈরি একটি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা যা কয়েকটি কম্পিউটারকে একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসত।
১৯৮৩ এর পর থেকে বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে আধুনিক ইন্টারনেট আবিষ্কারের দিকে এগুতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়া এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি করে বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বার্নাস লি’র World Wide Web বা WWW আবিষ্কারের মাধ্যমে। তার আবিষ্কার আজকের হাইপার-লিংক বা ওয়েবসাইট ভিত্তিক ইন্টারনেটের সূত্রপাত ঘটায়।
আরো পড়ুন: